আজ জামাই ষষ্ঠী

আজ জামাই ষষ্ঠী। পার্বণটি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের হলেও এর প্রভাব বাঙালী জীবনেও দেদীপ্যমান।

পার্বণটিতে প্রাচীণ ভারতবর্ষে বাঙালী সমাজে উৎসবমূখর আমেজ ছড়িয়ে দিতো। নানা কারণে এবং মানচিত্রের ভৌগলিক পরিবর্তনে সে অবস্থাটি এখন আর নেই। তারপরও পার্বণ হিসেবে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা উৎসবটি ধরে রেখেছে এবং আমাদের গ্রামীণ জীবনে এখনো এর সার্বজনীন আবহ দেখতে পাওয়া যায়।

জামাই ষষ্ঠীর সমস্ত আয়োজন করা হয় বাড়ির জামাইকে ঘিরে। জৈষ্ঠ্য মাসের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে এ লৌকিক আচারটি পালন করা হয় বলেই এর নাম জামাই ষষ্ঠী। অবশ্য এর আরেকটি নাম হচ্ছে অরণ্য ষষ্ঠী।

পূজা হয়ে থাকে ষষ্ঠী দেবীরও । ষষ্ঠী দেবী মাতৃত্বের প্রতীক। সে কারণে ষষ্ঠী প্রতিমাতে দেখা যায় তিনি কোলে সন্তান ধারণ করে আছেন। ষষ্ঠী মাতার কাছে জামাইদের জন্য দীর্ঘায়ু কামনা করা হয়।

ষষ্ঠী পূজার আরেকটি বিশিষ্ট দিক হচ্ছে বিড়াল সেবা । বাড়ির গৃহপালিত বিড়ালদের এদিন খুব সেবা দেওয়া হয়। কারণ বিড়াল ষষ্ঠী দেবীর বাহন।

সনাতন ধর্মাবলম্বী মতে, মূলত বিবিধ প্রকার ফলজ, বনজ ও ওষুধী গাছের ডাল একত্র করে অনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় স্নান দিয়ে পূজা করা হয়। প্রথমে জামাইরা তারপরে বাচ্চারা এবং সবশেষে বাড়ির বাকি সদস্যরা ষষ্টির জল নেয়। দূর্বা ঘাস জলে ডুবিয়ে শরীরে ছোঁয়ানো হয়। তারপর জলে ডোবানো পাখার বাতাস করতে করতে ‘ষাট ষাট, বালাই ষাট’ মন্ত্র আওড়ানো, সবশেষে দূর্বা পুঁটুলির চাল আর গামলাতে ডোবানো ফল হাতে দিয়ে প্রাথমিক ষষ্ঠীর ইতি টানা হয়। পরবর্তীতে শ্বাশুড়িরা মেয়ে জামাইকে নিয়ে মন্দিরে যান তাদের ভবিষ্যৎ মঙ্গল কামনার্থে।

এর পরের পর্বটি জামাইদের জন্য খুবই লোভনীয়। এ পর্বে দুপুরের ভুড়িভোজ, সাত রকমের ভাজা, শুক্তো, মুগের ডালের মুড়িঘন্ট, বিভিন্ন মাছের বাহারি রকমের পদ, কচি পাঁঠার ঝোল, চাটনি,দই-মিষ্টি, আম কাঁঠাল আরো কতো কি!

সকাল থেকে শ্বাশুড়ি মায়েরা এতোসব রান্না করেন। নিজেরা কিন্তু উপোস থাকেন কেউ কেউ আবার নিরামিশ খান।
সনাতন ধর্মাবলম্বী মতে, এই পার্বণ মূলত পরিবেশ রক্ষার্থে গাছ কে দেবতা বিশ্বাসে পূজা করা। কেননা এ আয়োজনে বিবিধ গাছের ডাল যেমন দরকার হয় তেমনি এ দিনে সনাতন পরিবারে থাকে বাহারি মৌসুমি ফল। কিন্তু এখন সময়ের পরিক্রমায় দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে এ পার্বনের মূল উদ্দেশ্য, শতবর্ষী ষষ্ঠী গাছ আর পূজার জন্য পাওয়া যায় না।

জৈষ্ঠ্যের মাঝামাঝি, যখন আম-কাঁঠালের গন্ধে চারদিক সুবাসিত, তখনই জামাই ষষ্ঠী ব্রতটি হওয়ায় এর হাওয়া ধর্মীয় গন্ডি পেরিয়ে প্রভাব ফেলে গ্রামীণ সাধারণ জনজীবনেও। এ সময় শ্বশুড় বাড়িতে জামাইরা নিমন্ত্রিত হন। ঠিক পূজোর মত না হলেও বাড়িতে বাড়িতে ‘জামাই আদরের’ ঘটা পড়ে যায়।

জামাইবাবাজী কিন্তু খালি হাতে শ্বশুরবাড়ি আসেনা, যতই আত্মভোলা হোক না কেন, শাশুড়ি মায়ের জন্য তাঁত বা ঢাকাই জামদানী, ঝুড়ি ভর্তি আম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, পান-সুপুরী, নদীর ঘাট থেকে কানকো নাড়ানো পাকা রুই বা কাতল মাছ, গরম রসগোল্লার হাঁড়ি, ছানার সন্দেশ ভর্তি বাক্স সাথে আনতে ভুলেনা।

পুরনো ঢাকা এবং চট্টগ্রামে মেয়ের বিয়ে পাকা হলে তখন উভয়পক্ষ নিমন্ত্রণ করে জ্যৈষ্ঠ মাসে আম-দুধ খাওয়ানোর প্রচলন রয়েছে। এছাড়াও বারোমাসির গানে দেখা যায়, জ্যৈষ্ঠ মাসে জামাতাকে শ্বশুরবাড়ি থেকে বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানিয়ে এসে আম-দুধসহ অন্যান্য খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যেও জ্যৈষ্ঠ মাসে জামাতাকে বাড়িতে এনে আম-দুধ খাওয়ানোর রেওয়াজ রয়েছে।

তবে জামাই ষষ্ঠীর উপাচারগুলো সব অঞ্চলে এক রকম নয়। অঞ্চল ভেদে এর ভিন্নতা রয়েছে।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)