আওয়ামী লীগের জন্য একটি কঠিন সতর্কবার্তা : আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী লীগ সরকার সম্পর্কে একটি কঠিন সতর্কবাণী উচ্চারণের সময় এখন এসেছে। দেশে যাদের সমর্থনের ওপর নির্ভর করে আওয়ামী লীগের যেসব মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, নেতা, পাতিনেতারা (একমাত্র শেখ হাসিনা ছাড়া) ভাবছেন, এবারের নির্বাচনে বিএনপি আসুক না আসুক, তারা উন্নয়নের তক্তা পিটিয়ে অনায়াসে জয় ছিনিয়ে আনবেন, তারা কুম্ভকর্ণের ঘুমের রাজ্যে বাস করছেন। প্রধানমন্ত্রী আমাকে ক্ষমা করবেন, আমার এ হুশিয়ারিটি তার জন্যও।

এবার দেশ ঘুরে এসে মনে হয়েছে, দেশে এখন পঁচাত্তরের আগস্ট মাসের আগের মাসের পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বাইরে আকাশ শান্ত। তখন সংসদের ভেতরে-বাইরে বঙ্গবন্ধু সরকারের কোনো বিরোধিতা নেই।

দলে দলে লোক, এমনকি দু-একজন বাদে বুদ্ধিজীবীরাও বাকশালে যোগ দিচ্ছেন। একদিন দেখলাম, প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে নতুন গণভবনের সামনে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন এবং কামরুল হাসান পর্যন্ত ঢোল বাজিয়ে নাচতে নাচতে বঙ্গবন্ধুকে সমর্থন জানাচ্ছেন। দেখলে মনে হবে, সারা দেশ বঙ্গবন্ধুকে নতমস্তকে কুর্নিশ করছে। তবে বিরোধী শিবিরে একটি লোকও নেই।

কিন্তু ভেতরে ভেতরে সবার অলক্ষ্যে নাগিনীরা যে এক হয়েছে এবং সময় বুঝে ছোবল মারার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে একথা অনেকে জেনেও না জানার ভান করছেন। আমি দূর বিদেশে থেকে দেশে গিয়েই টের পেয়েছি; দেখেছি দিনে যারা পরম মুজিব ভক্ত, তারাই রাতে গোপনে আড্ডায় বসে গুজব ছড়াচ্ছেন। দেশে রক্তপাত আসন্ন, রাজনীতিতে বিরাট পরিবর্তন আসছে এবং সেই পরিবর্তন এ আগস্ট মাসেই ঘটবে। বাজার গুজবে সয়লাব।

’৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময় লক্ষাধিক লোকের মৃত্যু হয়েছিল, যার পশ্চাতে ছিল মার্কিন চক্রান্ত। সেই দুর্ভিক্ষে পাঁচ লক্ষাধিক লোকের অনাহারে মৃত্যু হয়েছে বলে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। এ গুজব প্রতিহত করার ব্যাপারে সরকারি প্রচারযন্ত্র বিকল।

বিদেশে লাখ টাকা ব্যয় করে আন্তর্জাতিক পিআর বা পাবলিক রিলেশন্স এজেন্সি ভাড়া করে প্রচার চালানো হচ্ছে। মুজিব সরকার ফ্যাসিস্ট সরকার। তাদের রক্ষী বাহিনী হাজার হাজার বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী খুন করছে। দেশে কথা বলার অধিকার নেই। কেউ কথা বললেই গুম-খুন হয়ে যায়।

সিরাজ শিকদারকে বিনা বিচারে হত্যা করা হয়েছে। বাসন্তী নামের এক মেয়েকে নগ্ন করে ছেঁড়া জাল পরিয়ে ভাড়াটে ফটোগ্রাফার দিয়ে ছবি তুলে তা পিআর এজেন্সির মাধ্যমে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে দিয়ে প্রমাণ করাতে চেষ্টা করা হয়েছে শেখ মুজিবের শাসনে দেশের মানুষের পেটে অন্ন নেই, নারীদের লজ্জা ঢাকার বস্ত্র নেই।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে নতুন সরকার মাত্র গঠিত হয়েছে। তাদের সাংগঠনিক ও প্রচারণার দক্ষতা খুবই কম। বিশ্বময় প্রভাবশালী পিআর এজেন্সি ভাড়া করে কাউন্টার প্রোপাগান্ডা চালানোর অর্থবলও তাদের ছিল না। পক্ষান্তরে বিরোধীদের হাতে ছিল অঢেল পেট্রোডলার এবং আন্তর্জাতিক মদদ।

বাংলাদেশে তখন কাউন্টার রেভ্যুলিউশন ঘটাতে চায় এমন দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তান তো ছিলই, তার সঙ্গে নিজ নিজ রাষ্ট্রীয় স্বার্থে হাত মিলিয়ে ছিল তখনকার চীন, সৌদি আরব ও আমেরিকা। আমেরিকা তো যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ আখ্যা দিয়ে মুজিব সরকারের বিরুদ্ধে বিরামহীন প্রচার চালাচ্ছিল।

এ বিদেশি চক্রান্তের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেশের ভেতরে একাত্তরের পরাজিত শত্রুরা ঐক্যবদ্ধ হয়। সামরিক বাহিনীর ক্ষমতালিপ্সু সেনাপতিদের তারা দলে টানে। আওয়ামী লীগের ভেতরেও খোন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে ঘাতক বাহিনী তৈরি হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূর্য আবার অস্তমিত হয়। শেখ মুজিব ও জাতীয় নেতাদের হত্যার পর এ চক্রান্তের কথা ফাঁস হয়ে যায়।

মুজিব সরকারের সঙ্গে চুক্তি করার পরও আমেরিকা কীভাবে ’৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের আগে বাংলাদেশে খাদ্য পাঠানো ইচ্ছাকৃতভাবে বিলম্বিত করে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করেছে, দেশের ভেতরের চক্রান্তকারীরা এক ফটোগ্রাফারকে অর্থ দিয়ে বাসন্তীকে জাল পরিয়ে ছবি তুলে প্রচার করেছে, তা জানাজানি হয়। বাংলাদেশে ’৭৪ সালে মার্কিনসৃষ্ট দুর্ভিক্ষের কথা মার্কিন জার্নাল ‘ফরেন অ্যাফেয়ার্সে’, ‘ফুড অ্যাজ এ উইপন’ শীর্ষক নিবন্ধে স্বীকার করা হয়।

এখানে বিশাল অঙ্কের টাকার বিনিময়ে অত্যন্ত শক্তিশালী আন্তর্জাতিক পিআর এজেন্সিগুলো দিয়ে কীভাবে একটি রাষ্ট্রের সরকারের বিরুদ্ধে প্রচার চালানো হয় এবং বহির্বিশ্বের মানুষের কাছে তা বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা যায়, তার প্রমাণ আমরা বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে, আলেন্দের চিলিতে ও নক্রুমার ঘানায় এবং আরও অনেক রাষ্ট্রে দেখেছি।

এ প্রচার আন্তর্জাতিক পিআর এজেন্সিগুলো তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তির ফলে বিশ্বের প্রভাবশালী টাইমস, গার্ডিয়ান, ইকোনমিস্ট, নিউইয়র্ক টাইমস ইত্যাদি সংবাদপত্রে এখন ঢালাওভাবে চালায় যে তা পাশ্চাত্যের অনেক মানবতাবাদী শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবী পর্যন্ত বিশ্বাস করেন এবং তারা তার প্রতিবাদ করা দরকার মনে করেন।

এ প্রতিবাদ বা যুক্ত বিবৃতির খসড়া তৈরি করা এবং তাতে মনীষী ও বুদ্ধিজীবীদের সই সংগ্রহ করার কাজটিও পিআর কোম্পানিগুলো করে।

সব ক্ষেত্রে যে এটা ঘটে তা নয়। তবে দেশীয় প্রতিক্রিয়াশীল চক্র এবং বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যে সব সরকারকে উচ্ছেদ করার জন্য ষড়যন্ত্র করে, তাদের বেলাতেই এ কৌশল বেশি প্রযুক্ত হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রথমদিকে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা টাকা ছড়িয়ে পিআর কোম্পানি ভাড়া করে বিশ্বময় প্রচার শুরু করেছিল, পাকিস্তানি সৈন্যরা বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু করেনি। এটা করছে দেশটিতে ঢুকে পড়া ভারতীয় সৈন্য ও তাদের সহায়ক বিচ্ছিন্নতাবাদী দুষ্কৃতরা।

এ প্রচারণা অক্সফোর্ডে বসে প্রবীণ বুদ্ধিজীবী নীরদ সি চৌধুরী এবং বিখ্যাত ঔপন্যাসিক নাইপল (সম্প্রতি প্রয়াত) পর্যন্ত বিশ্বাস করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছিলেন। পরে তাদের ভুল ভাঙে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা মেনে নেয়ার পরও পাকিস্তানের সিভিল ও মিলিটারি কোনো সরকারই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিশ্বের নামিদামি লেখক ভাড়া করে তাদের মাধ্যমে মিথ্যা প্রচার চালাতে দ্বিধা করেনি।

এমনকি বাংলাদেশের ভেতর থেকেও তারা পণ্ডিত বলে পরিচিত অসত্য প্রচারকারী সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছে। তাদের ভেতর ড. জি. ডব্লিউ চৌধুরী (গোলাম ওয়াহেদ চৌধুরী) অন্যতম। তার লেখা ‘লাস্ট ডেজ অব ইউনাইটেড পাকিস্তান’ গ্রন্থে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও শেখ মুজিব সম্পর্কে অসংখ্য মিথ্যা বিবরণ দেয়া হয়।

অতীতের এসব কাসুন্দি ঘেঁটে আর লাভ নেই। এসব কথা সবার জানা। তবুও বর্তমানে হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী যে প্রোপাগান্ডা-ওয়ার চালানো হচ্ছে, তার পটভূমি মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্যই অতীতের কিছু কাহিনী তুলে ধরলাম।

হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধেও প্রোপাগান্ডা-ওয়ার চালানোর জন্য তার বিরোধী পক্ষ- বিশেষ করে বিএনপি, জামায়াত ও একটি তথাকথিত সুশীল সমাজের অর্থবল অনেক বেশি।

মধ্যপ্রাচ্য থেকে জামায়াত দেদার পেট্রোডলার পায়, অতীতের বিএনপি সরকারের কল্যাণে দেশেও শিল্প বাণিজ্য, ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স ব্যবসাতে তাদের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিএনপির রয়েছে পাকিস্তানের মতো পেট্রন। আর আমাদের সুশীল সমাজটি ‘স্টাডি সেন্টার, রিসার্চ সেন্টার প্রতিষ্ঠার নামে, সেমিনার, গোলটেবিল বৈঠক করার (যার অধিকাংশই সরকারবিরোধী) কভারে নানা ধরনের এনজিও প্রতিষ্ঠা করে পশ্চিমা দেশগুলো থেকে সাহায্য ভালোই পান।

অনেকে বলেন, কেবল বিএনপি-জামায়াতের যে অর্থবল (এবং বিলেতে তারেক রহমান বিভিন্ন সূত্র থেকে যে টাকা পান) তার বার্ষিক যোগফল বাংলাদেশ সরকারের এক বছরের বাজেট-ব্যয়ের চাইতেও বহুগুণ বেশি। প্রোপাগান্ডা-ওয়ারে বিএনপি-জামায়াতের মতো অর্থব্যয় আওয়ামী লীগ বা তার সরকারের পক্ষে করা খুবই কঠিন। আমাদের সুশীল সমাজও নিষ্কলুষ নন, তাদের পেছনে রয়েছে পশ্চিমা মদদ।

তাছাড়া বাংলাদেশ থেকে অনেক জামায়াতি এবং তাদের যুদ্ধাপরাধী নেতা ব্রিটেনে এসে আশ্রয় নিয়েছেন, তাদের রয়েছে সৌদি কানেকশন। বাঙালি অধ্যুষিত পূর্ব লন্ডনে তারা বিরাট শক্তিশালী। এখানেও ব্যবসা-বাণিজ্যে তারা জাঁকিয়ে বসেছেন। অধিকাংশ মসজিদ-মাদ্রাসা তাদের দখলে। এখান থেকেও চলে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা। বাংলা মিডিয়াগুলোতেও তারা প্রভাব বিস্তার করেছে।

দু-একটি মিডিয়া ছাড়া অধিকাংশ মিডিয়ায় চলে হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে খবর ও মন্তব্য প্রকাশ। এর কোনো পাল্টা প্রোপাগান্ডা বা দেশের প্রকৃত পরিস্থিতি বাঙালি কমিউনিটিকে জানানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। বাংলাদেশ হাইকমিশন এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ ব্যর্থ।

প্রতি বছর রমজান মাস এলেই লন্ডনের ও নিউইয়র্কের বাংলা টেলিভিশনগুলোতে একশ্রেণীর আলেমের আবির্ভাব ঘটে। তারা ধর্ম প্রচারের আড়ালে দেশের বিভিন্ন স্থানে মসজিদ-মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার নামে বাঙালি মুসলমানদের জাকাত-ফিতরার অর্থ ছাড়াও বিপুল অর্থ ডোনেশন হিসেবে দেয়ার জন্য সারাদিন আবেদন জানাতে থাকেন। তাতে লাখ লাখ পাউন্ড উঠে। এ অর্থের সবটা সত্যিই কোনো মসজিদ বা মাদ্রাসা ফান্ডে যায় কিনা, তার কোনো হদিস নেই। জামায়াতি আলেমরাই এভাবে টাকা তোলেন বেশি।

এভাবে বছরের পর বছর চলছিল। সম্প্রতি ব্রিটিশ সরকার এ ব্যাপারে সচেতন হয়েছে। জিহাদিস্টরা তাদের সন্ত্রাস চালানোর জন্য এত অর্থ কোথায় পায়, তার সন্ধান করতে গিয়ে এক ধরনের ইসলামী ব্যাংকে জিহাদিস্টদের বিরাট তহবিলের খবর জানা গেছে। প্রতি রমজান মাসে টেলিভিশনে প্রচারের মাধ্যমে সংগৃহীত বিপুল টাকার একটা অংশ এ সন্ত্রাসের কাজেও ব্যবহৃত হয় বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। আমার সন্দেহ এ টাকার একটা বড় অংশ জামায়াতিদের বাংলাদেশবিরোধী প্রচার-প্রোপাগান্ডার কাজেও যায়।

বর্তমানে বিশ্বময় হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে যে প্রোপাগান্ডা-ওয়ার চলছে, তার উৎস কোথায়, অর্থ কোথা থেকে আসে, ভালোভাবে তার তদন্ত হলে অনেক বিস্ময়কর তথ্য জানা যাবে। বাংলাদেশে কোটা পদ্ধতিবিরোধী আইন বাতিলের ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনের পর সরকারবিরোধী প্রচার-প্রচারণা এবং বহির্বিশ্বে পিআর এজেন্সির মাধ্যমে তা ছড়িয়ে দেয়ার জন্য যে ব্যাপক তৎপরতা শুরু হয়েছে, তা ’৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারণার সঙ্গে তুলনীয়।

দেশেও ’৭৫ এর সঙ্গে তুলনীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে। এ ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির বর্তমান কুশীলব এবং বহির্বিশ্বে তাদের এজেন্ট কারা, সে সম্পর্কে একটি বিস্তারিত আলোচনা দরকার। এ আলোচনা দ্বারা আওয়ামী লীগ দল ও সরকারের কাছে একটি কঠিন সতর্কবার্তা পাঠাতে চাই।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)